ডক্টর তুহিন মালিক: ১। ভারত থেকে কি কি নিয়ে এলেন? আজকের সংবাদ সম্মেলনে আপনি তার একটারও প্রমান দিতে পারলেন না। অথচ জনগণের প্রত্যাশা ছিল- ‘ভারতকে সারাজীবন মনে রাখার মত’ আপনার দেয়া ট্রানজিট, বানিজ্য, কানেক্টিভিটি, ৭ রাজ্যের নিরাপত্তা, নদী, সমুদ্র, বন্দর, সুন্দরবন, প্রতিরক্ষা, বৃহত্তম রেমিটেন্স, অবাধ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে আপনি প্রতিবারের মত এবারও হয়ত খালি হাতে ফিরবেন না।
২। আপনার সফরের আগে আমি খুব চ্যালেঞ্জ দিয়েই বলেছিলাম, ‘সব প্রধানমন্ত্রীই বিদেশ সফরে কিছু না কিছু আনতে যায়। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে গিয়ে সবকিছু উজাড় করে দিয়ে যায়! আর তাই, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে গেলেই দেশের মানুষের উৎকন্ঠা বেড়ে যায়। ‘এবারও না জানি কিসব দিয়ে আসে?’ অথচ এবারও আপনি যথারীতি দেশের মানুষের উৎকন্ঠার কোন তোয়াক্কা করলেন না! আপনি আপনার দেশের স্বার্থ বিলিয়ে দেয়ার চ্যালেঞ্জ থেকে সরে আসতেই পারলেন না!
৩। ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর কেন দিয়ে আসলেন? আজকের সংবাদ সম্মেলনে তার কোন সদুত্তর দিতে পারলেন না। উল্টা বরং আমাদের বন্দরগুলো ব্যবহারে ভারতের অধিকারও আছে বলে যে জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী ঘোষনা দিলেন, তাতে গোটা দেশবাসী আজ বিস্মৃত ও মর্মাহত!
৪। আপনার সফরের দুই দিন আগে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলেছিলাম, ‘এবারও তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো চুক্তি হবে না। ‘ঠিক তাই হলো, আপনি তো তিস্তার পানি চাইতেই পারলেন না। বরং উল্টা ফেনী নদীর পানি দিয়ে আসলেন ভারতকে! আর এখন দিলদরিয়া বলে দিলেন, ‘কেউ পানি চাইলে, তা যদি না দেই, সেটা কেমন দেখায়?’ অথচ আপনি ভুলেই গেছেন, আপনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, ত্রিপুরার মূখ্যমন্ত্রী নন! আপনার সাংবিধানিক দায়িত্ব নিজ দেশের মানুষের ন্যয্য পানির অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। নিজেদের পানি চাহিবামাত্র বিনাস্বার্থে অন্যকে উজাড় করে দিয়ে আসা নয়!
৫। দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল, আপনার সফরে দুই দেশের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দৃশ্যমান নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। অথচ আপনার যৌথ বিবৃতিতে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি পর্যন্ত একবারের জন্যও উচ্চারণ করেননি! ‘রোহিঙ্গা’ না বলে, বললেন ‘মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে আশ্রয়চ্যুত মানুষজন’। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে ভোটদানে বিরতথাকা ভারতকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চাপ দেওয়া তো দূরের কথা। বরং রোহিঙ্গাদের জন্য ভারতের নামমাত্র তুচ্ছ ত্রাণের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে করতেই তো পুরো সময়টা পার করে দিলেন!
৬। চরমভাবে উদ্বিগ্ন দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল, আসামের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) বিষয়ে আপনি একটি পরিস্কার বার্তা নিয়ে আসবেন। অথচ যৌথ বিবৃতির কোথাও ‘এনআরসি’ শব্দটির পর্যন্ত কোন উল্লেখ রাখলেন না। আপনার সরকার দাবী করেছিল, ‘নিউ ইয়র্কের বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করে বলেছেন এতে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু নেই।’ অথচ এই কথাটাই নরেন্দ্র মোদীর নিজের মুখ থেকে একটি বারের জন্যও বলাতে পারলেন না! এমনকি ভারত সরকারের যেকোন পর্যায় থেকে এই আশ্বস্ত বাণীটির প্রকাশ্য একটা ঘোষনাও আদায় করতে পারলেন না!
৭। আপনি ভারতে গেছেন তিস্তার পানি আনতে, আর ভারতকে দিয়ে আসলেন গ্যাস! আবার আজকের সংবাদ সম্মেলনে উদ্ভট বলছেন, ‘বটল গ্যাস দিচ্ছি… আমদানি করে দিচ্ছি… গ্যাসের কিছু ত্রিপুরায় দিচ্ছি…।’ আর সেই পুরোনো গদ! জনগণের প্রশ্নের জবাব না দিতে পেরে ‘বিএনপির ২৯ বছর আগের গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার’ ভারতবিরোধী রুপকথা শোনাচ্ছেন!
৮। সফরের দুদিন আগেই বলেছিলাম, ‘এই সফরে সীমান্ত হত্যা বা বানিজ্য ঘাটতির মত ইস্যুগুলো কোন এজেন্ডায় স্থান খুঁজে পাবে না!’ আর হয়েছেও তাই! বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে, বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে, এ কথাগুলো বলার মত কোন সৎসাহস কেন পেলেন না? না হয়, হিন্দিতেই রসিকতা করে হলেও তো এ দাবীগুলো তুলতে পারতেন!
৯। আপনি শূন্য হাতে ফিরে আসার আগে কাউকে না জানিয়ে ভয়াবহ আরেক বিপর্যয়ের চুক্তি করে আসলেন। ভারতকে আমাদের উপকূলে নজরদারির জন্য ২০টি রাডার স্থাপনে অনুমোদন দিয়ে চুক্তি করে আসলেন। যার ফলে, পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সামরিক সংঘাতের মাঝে পড়ে বাংলাদেশ এখন চীনের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক নষ্টের দারপ্রান্তে উপনীত। চীন-ভারতের সামরিক সংঘাতের বলির শিকারে পরিনত করার চুক্তি কেন করে আসলেন? এই চুক্তি করে নিরাপদ করে দিয়ে আসলেন ভারতকে! আর আঞ্চলিক সংঘাতের বলির শিকারে পরিনত করে দিয়ে আসলেন বাংলাদেশকে!
১০। ভারতকে বিলিয়ে দেয়া জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী চুক্তি করে আপনি সংবিধান লংঘন করেছেন। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সমুদ্র বন্দর, ফেনী নদীর পানি, উপকূলে ভারতের নজরদারির জন্য ২০টি রাডার স্থাপন এবং জ্বালানী সঙ্কটময় দেশের গ্যাস ভারতের হাতে তুলে দেয়ার যে চুক্তি করা হলো, তা সুস্পষ্টভাবে সংবিধান পরিপন্থী। এটা বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪৫ক অনুচ্ছেদের গুরুতর লংঘন। যা সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদের অধীনে সংবিধান লংঘনজনিত রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধের শামিল। সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদের অধীনে যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আপনি রাষ্ট্র বিরোধী ও জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী এইসব চুক্তি করে সাংবিধানিক শপথ ভংগ করেছেন। দেশের স্বার্থরক্ষায় কৃত শপথ ভঙ্গের প্রমান দিয়েছেন। নিজ দেশের স্বার্থের চাইতে বিদেশি রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করেছেন। আপনি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার সকল সাংবিধানিক অধিকার হারিয়েছেন।
১১। আপনি ভারতকে সব উজাড় করে দিয়ে আসলেন! এটা চাপা দিতে আগে থেকেই ধরে রাখা ক্যাসিনো সম্রাটকে গ্রেফতারের ইস্যু দিয়ে মিডিয়ার মুখ বন্ধ রাখলেন! দেশের স্বার্থে ছাত্র জনতা প্রতিবাদ ও লেখালেখি করলে, আপনি ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অপরাধে আপনার ছাত্র সংগঠনের উগ্র অনুসারীদের হাতে পিটিয়ে মারলেন এক প্রতিবাদী ছাত্রকে! আর এখন চাপে পড়ে বলছেন, আপনি মায়ের মতো হত্যার বিচার করবেন? কই, বিশ্বজিত হত্যার বিচার তো মায়ের মতো আপনি করেননি। এতদিন কি মা হওয়ার মত বয়স আপনার ছিল না?
১২। আপনার দাসত্ব ও প্রভূভক্তিই কি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরাধীন জনগোষ্ঠীর প্রাপ্তি? প্রধানমন্ত্রী জবাব দিবেন কি?
লেখক: আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ