একই দিনে অর্থাৎ ১লা ডিসেম্বর, বাংলাদেশের বর্তমান কতৃত্ববাদী সরকারের ওপরে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন চরম চাপ প্রয়োগ করেছে। এর মূল কারণ, গত ১৫ বছর ধরে বিনাভোটে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা আরেকটি জালিয়াতির নির্বাচনের আয়োজন করেছেন। এই নির্বাচন নিয়েই জাতিসংঘ সহ পশ্চিমা দেশগুলি আপত্তি তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্র
শুক্রবার ১ ডিসেম্বর সন্ত্রাসবাদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘কান্ট্রি রিপোর্টস অন টেররিজম ২০২২’ প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশ অংশে এ কথা বলা হয়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। উল্লেখযোগ্য মানবাধিকার বিষয়গুলির মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্ট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে: বিচারবহির্ভূত হত্যা সহ বেআইনি বা নির্বিচারে হত্যা; জোরপূর্বক অন্তর্ধান; সরকার কর্তৃক নির্যাতন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি; কঠোর এবং জীবন-হুমকি কারাগারের অবস্থা; নির্বিচারে গ্রেপ্তার বা আটক; রাজনৈতিক বন্দী বা বন্দী; অন্য দেশে ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক দমন; বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে গুরুতর সমস্যা; গোপনীয়তার সাথে স্বেচ্ছাচারী বা বেআইনী হস্তক্ষেপ; কোনো আত্মীয়ের দ্বারা অভিযুক্ত অপরাধের জন্য পরিবারের সদস্যদের শাস্তি; সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা সহিংসতার হুমকি, সাংবাদিকদের অযৌক্তিক গ্রেপ্তার বা বিচার, সেন্সরশিপ, এবং মতপ্রকাশ সীমিত করার জন্য ফৌজদারি মানহানি আইন বলবৎকরণ বা হুমকি সহ স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং মিডিয়ার উপর গুরুতর বিধিনিষেধ; ইন্টারনেট স্বাধীনতার উপর গুরুতর নিষেধাজ্ঞা; শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা এবং অ্যাসোসিয়েশনের স্বাধীনতার সাথে উল্লেখযোগ্য হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক অংশগ্রহণের উপর গুরুতর এবং অযৌক্তিক বিধিনিষেধ। কতৃত্ববাদী ও ম্যান্ডেটহীন সরকারের এত এত গুরুতর অপরাধের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড় ধরনের ব্যবস্খা আসতে পারে এমনটাই ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে মারাত্মক টেনশন বিরাজ করছে। উল্লেখ্য, দু’বছর আগে ১০ই ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসে বাংলাদেশের ৮ পুলিশ ও সেনা কর্মকার্তার বিরুদ্ধে এবং প্রতিষ্ঠান হিসাবে র্যা বের ওপরে গ্লোবাল ম্যাননেটস্কি নিষেধাজ্ঞা জারী করে যুক্তরাষ্ট্র, যা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার এখনও অস্বস্থিতে আছে। এবারেও সেই দিবসের সপ্তাহখানেক আগেই আরও ব্যবস্থা গ্রহণের সকল ক্ষেত্র প্রস্তুত।
যুক্তরাষ্ট্র গত মে’২৩ মাস থেকে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিদের ওপরে (যারা সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে অন্তরায়) ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে। এর পাশাপাশি শ্রমঅধিকার লংঘনের দায়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা, বানিজ্যিক অবরোধ সহ নানাবিধ ব্যবস্খা নেয়ার অভাস দিয়েছে, যা কূটনৈতিক পত্র চালাচালিতেও প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশে বিরোধী দলকে পদ্ধতিগত নিপিড়ন করে নির্বাচনের বাইরে রেখে চলমান একতরফা নির্বাচনের বিরোধিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে অনেক কূটনৈতিক দৌড়ঝাপও হয়েছে। অন্যদিকে, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, ও শ্রমঅধিকার প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্খানকে ঢাকার বর্তমান শাসকরা “রেজিম চেঞ্জ” হিসাবে উল্লেখ করে বলছে, তাদের নির্বাচনকে ভন্ডুল করতেই যুক্তরাষ্ট্রের এতবিধ ব্যবস্খা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে তার মন্ত্রীরা ও নেতারা এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে থাকেন। তেমনি অবস্থা দেখা গেলো, আওয়ামী লীগ সরকারের শিল্পমন্ত্রী এডভোকেট নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন ১ ডিসেম্বর এক সভায় বলেন, “আমরা বিশাল ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছি, আমাদের ৭ তারিখ নির্বাচন, আমরা এখনো জানিনা সেটা হবে কিনা? একটা অনিশ্চিত অবস্থা! এর আগের দিন মার্কিন রাষ্ট্রেদূতের সাথে পররাষ্ট্র সচিবের যে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে, তারপরে সরকারের মধ্যে ব্যাপক চ্যাঞ্ছল্য- ঘন ঘন মিটিং করছেন সরকারের সচিবরা, খবরে লেখা হয়, নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলা করতেই নাকি এসব বৈঠক!
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রকাশ করা এক প্রতিবেদন উঠে এসেছে, বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা অব্যাহত রাখতে হলে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তার্জাতিক চুক্তি বাস্তবায়ন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশ ও সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা সুরক্ষা, নাগরিক সমাজের দায়িত্ব পালনে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করার কথা বলা হয়েছে। সেই সাথে নির্যাতনের অভিযোগ, অন্যায় আচরণ, বিচারবহির্ভুত হত্যা, গুমের বিষয় তদন্ত করতে হবে এবং শ্রমনীতি বাস্তবায়নের আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য, শ্রমখাতে জাতীয় পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখাতে হবে। বাংলাদেশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে বানিজ্যের ক্ষেত্রে জিএসপি-প্লাস সুবিধা পায়, যার কারণে পোষাক শিল্প সহ সব ধরণের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে নির্ধারিত ১২ শতাংশ শুল্ক দিতে হয় না। এই সুবিধা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে চলমান একপেশে নির্বাচন নিয়ে আপত্তি তুলে ধরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় ইইউ এবং বিশ্ব।
জাতিসংঘ
একই দিনে অর্থাৎ ১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিক জানিয়েছেন, বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হতে হবে সবার অংশগ্রহণে। এর আগে জাতিসংঘ জানিয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের আয়োজিত চলমান নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে না জাতিসংঘ। যার মানে, নির্বাচনের বর্তমান শিডিউল এবং আয়োজন নাকচ করলো জাতিসংঘ।
বাংলাদেশে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে পদ্ধতিগতভাবে নির্বাচনের বাইরে রাখতে সারা দেশে সাড়াঁশি আক্রমন চালিয়ে অন্তত কুড়ি হাজার মানুষকে জেলে পুড়ে এবং ২ কোটি মানুষকে হামলার ওপরে রেখে একটি একতরফা নির্বাচন আয়োজন করেছেন শেখ হাসিনা, যা তাকে নিশ্চিতভাবে জয়ী দেখায়। সরকারের নানাবিধ আয়োজন এবং প্রচারণার পরেও যুক্তরাষ্ট্র সহ দাতারা এই নির্বাচন আয়েজনকে মেনে নিচ্ছেন না। এরপরে তাদের কাছ থেকে কি ব্যবস্খা আসে, তা নিয়ে অনেকের আগ্রহ। যদিও নির্বাচনের বাকী এক মাসেরও বেশি, এরমধ্যে যেকোনো চাপে বা অতীতের পূণরাবৃত্তিতে নির্বাচন পণ্ড হতে পারে, এমন আশঙ্কা খোদ সরকারের।