28, March, 2024
Home » ভুয়া শিক্ষকদের পকেটে সাড়ে ২৬ কোটি টাকা
blogimage14

ভুয়া শিক্ষকদের পকেটে সাড়ে ২৬ কোটি টাকা

327 views

ঢাকার হাম্মাদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নজরুল ইসলাম জাল ‘শিক্ষক নিবন্ধন’ সনদে প্রায় এক যুগ শিক্ষকতা করেন। মহসিন নামের অপর ব্যক্তির সনদও জাল করেছিলেন তিনিই।

২০০৮ সাল থেকে এ শিক্ষক সরকারি বেতন-ভাতা (এমপিও) গ্রহণ করেন। এ শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিস থেকে ১৫ নভেম্বর স্কুলে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এদিকে পটুয়াখালীর ধুলিয়া হাইস্কুল ও কলেজের প্রভাষক অজয় কৃষ্ণ দাসও জাল সনদে চাকরি নেন। তিনি এমপিও হিসাবে সরকারি কোষাগার থেকেই ২ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫০ টাকা গ্রহণ করেছেন। দুমকির জয়গুনেনেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাহমুদাও জাল নিবন্ধন সনদে চাকরি নিয়ে ৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা বেতন নিয়েছেন। জালিয়াতি ধরা পড়ার পর এ তিন শিক্ষকই পদত্যাগ করে চলে গেছেন।

শুধু এ তিনজনই নন, সরকারের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) এ পর্যন্ত ১৫৭৭ জন শিক্ষককে চিহ্নিত করেছে যাদের কেউ নিবন্ধন সনদ আবার কেউ বিভিন্ন স্তরের একাডেমিক, ডিপ্লোমা ও পেশাগত সনদ জাল করে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় চাকরি নিয়েছেন। এসব শিক্ষক সরকারি কোষাগার থেকে সাড়ে ২৬ কোটি টাকা এমপিও হিসাবে নিয়েছেন। ২০১৩ সাল থেকে ২০২০ সালের ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তদন্ত চালিয়ে সংস্থাটি এ তথ্য বের করেছে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সংস্থাটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করে। ডিআইএ পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর যুগান্তরকে বলেন, সারা দেশে প্রায় ৩৬ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। সব প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শন ও তদন্ত করা গেলে ভুয়া সনদে নিযুক্ত আরও শত শত শিক্ষক শনাক্ত হবেন। জনবল সংকটের কারণে প্রত্যাশিত পর্যায়ে তদন্ত করা যাচ্ছে না। জাল সনদে চাকরি নেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে তারা সাধারণত সুপারিশসহ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়ে থাকেন বলে জানান তিনি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৫ সাল থেকে জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে সরকারি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করছে। এর আগে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেরাই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ করত। অবশ্য ওইসব নিয়োগ বোর্ডে সরকারি প্রতিনিধি থাকতেন। এ কারণে প্রশ্ন উঠেছে, একজন শিক্ষক নিয়োগ পাওয়ার আগে তার কাগজপত্র স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় যাচাই হওয়ার কথা। এছাড়া এসব শিক্ষক যখন এমপিওভুক্ত হয়েছেন তখনও তার কাগজপত্র যাচাই হওয়ার কথা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি)। প্রশ্ন উঠেছে, এতকিছুর পরে কী করে জাল সনদে নিয়োগের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টরা এমপিওভুক্ত হয়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষা প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের জাল সনদ ধারীদের ধরার ব্যাপারে অনীহা আছে। শিক্ষক নিবন্ধন সনদ প্রত্যয়নকারী সংস্থা এনটিআরসিএ, মাউশি এবং মন্ত্রণালয়ে একটি চক্র আছে। তারা পরস্পর যোগসাজশে একদিকে ভুয়া সনদধারীদের রক্ষা করছে। আরেকদিকে প্রয়োজনে ভুয়া সনদ পেতেও সহায়তা করছে। এ ব্যাপারে ডিআইএর এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, জালিয়াতদের শনাক্ত করে দেওয়া হলেও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে কেউ কেউ পার পেয়েছেন। এমন একটি ঘটনায় তথ্য উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, খুলনার দৌলতপুরের একটি কলেজের হিসাববিজ্ঞানের এক প্রভাষক জাল সনদে চাকরি নেন বলে তাদের তদন্তে ২০১৮ সালে ধরা পরে। ২১ জানুয়ারি তাকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছে মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা শাখা। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি ডিআইএ ভুল করে কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়ে থাকে, তাহলে মন্ত্রণালয় কৈফিয়ত তলব করতে পারে। তা না করে কীভাবে দোষীকে নির্দোষ বলে সনদ দিল।

এ প্রসঙ্গে ডিআইএ পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, তার কর্মকর্তারা যখন তদন্তে যান, তখন কোনো শিক্ষক যেসব সনদে চাকরি নেন সেটি প্রমাণ হিসাবে নিয়ে আসা হয়। পরে তা যাচাই করা হয়। এর মধ্যে শিক্ষক নিবন্ধন সনদ প্রত্যয়ন করে এনটিআরসিএ। তাদের যাচাইয়ে জাল পেলে সেইভাবে প্রতিবেদন করা হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় পাওয়া প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি (আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগে) আরেকটি সনদ হাজির করেছেন। পরে তার আলোকে দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এমন ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপিত সনদটি হয়তো আসল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যদি তাই হয়, তাহলে আসল সনদটি এলো কোথা থেকে। আর চাকরি নেওয়ার সময়ে সংশ্লিষ্ট আবেদনকারী সেটি দাখিল করলেন না কেন। কিংবা, এক সনদে চাকরি নিয়ে পরে আরেক সনদ প্রদর্শন করলে চাকরির বৈধতা থাকে কিনা। এসব নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান প্রয়োজন।

জানা গেছে, ডিআইএ ছাড়াও স্থানীয়ভাবে অনেকে অনেক সময়ে এনটিআরসিএতে জাল সনদের অভিযোগ করে থাকে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে এনটিআরসিএতে চিঠি দিয়ে সনদ যাচাই করে। আর সাম্প্রতিক কালে নতুন জাতীয়করণ হওয়া কলেজ শিক্ষকদের চাকরি সরকারি করতে গিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা মাউশি সনদ যাচাই করছে। এতে বেশকিছু সনদ জাল হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।

জানা গেছে, স্থানীয় সূত্র থেকে অনুরোধের পরই হাম্মাদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকের সনদটি জাল হিসাবে ধরা পড়ে। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক সুলতান নূরী যুগান্তরকে বলেন, জাল শনাক্তের পর গত বছরের ১০ নভেম্বর ওই শিক্ষক পদত্যাগ করে চলে গেছেন। কর্মরত না থাকায় তার বিরুদ্ধে আর মামলা করা হয়নি। আর পটুয়াখালীর ধুলিয়া হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক এবং দুমকির জয়গুননেছার শিক্ষকের জাল সনদ ধরা পড়ে ডিআইএর তদন্তে। ধুলিয়া হাইস্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ জহিরুল ইসলাম বলেন, অজয় কৃষ্ণ দাস নামে তাদের যে প্রভাষকের সনদ জাল হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে তিনি পরে পদত্যাগ করে চলে গেছেন। জয়গুননেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইউসুফ আলি হাওলাদার যুগান্তরকে বলেন, মাহমুদা নামের ওই শিক্ষকও পদত্যাগ করে চলে গেছেন। আর সদ্য জাতীয়করণ হওয়া কুষ্টিয়ার কুমারখালী সরকারি কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক সাবিরা খাতুনের সনদ ভুয়া বলে প্রত্যয়ন করে এনটিআরসিএ। গত বছর সেপ্টেম্বরে এক চিঠিতে সংস্থাটি মামলা করতে কলেজকে নির্দেশনা দেয়। এই শিক্ষক ২০১১ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারি নিয়োগ পান এবং অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে ১ মে এমপিওভুক্ত হন। জাল সনদে চাকরি নেওয়ার দায়ে রংপুরের বদরগঞ্জ সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক নিরঞ্জন কুমার রায়ের বিরুদ্ধেও ২৭ জুলাই বদরগঞ্জ থানায় মামলা হয়েছে। নওগাঁর মান্দা উপজেলার উত্তরা ডিগ্রি কলেজের রমেন কুমার সাহার বিরুদ্ধেও একই কারণে নভেম্বরে মামলা করে তার প্রতিষ্ঠান।

এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিন (বৃহস্পতিবার বদলি হয়েছেন) যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন উৎস থেকে শিক্ষক নিবন্ধন সনদ যাচাইয়ের বেশকিছু আবেদন পেয়েছি। যাচাইয়ে যেসব শিক্ষকের সনদ জাল হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলাসহ আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়া জালিয়াতদের বিরুদ্ধে আইনগত অন্যান্য ব্যবস্থা নিতে মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হয়।

জালিয়াতদের পকেটে ২৬ কোটি টাকা : সম্প্রতি ডিআইএ থেকে মন্ত্রণালয়ে জাল সনদ শনাক্ত সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের ১৬ ফেব্র“য়ারি খুলনা ও বরিশাল বিভাগে ১২১২টি ভুয়া সনদ চিহ্নিত হয়েছে। এরমধ্যে শিক্ষক নিবন্ধন সনদ ১৪৩টি এবং কম্পিউটার সনদ ৬০টি। বাকিগুলো বিভিন্ন একাডেমিক এবং শারীরিক শিক্ষার সনদ। এসব শিক্ষকের মধ্যে যারা এমপিওভুক্ত তারা ১০ কোটি ৫৩ লাখ ৮৭ হাজার ৩৪৬ টাকা গ্রহণ করেছেন। সংস্থার ঢাকা বিভাগীয় অধিক্ষেত্রে ভুয়া সনদধারী চিহ্নিত হয়েছেন ৩২১ জন। তারা সরকারের কোষাগার থেকে নিয়েছেন ১৩ কোটি ৫২ লাখ ৩০ হাজার ৪৮৭ টাকা। আর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে মোট জাল সনদধারী চিহ্নিত হয়েছেন ৪০ জন। তারা এমপিও হিসাবে সরকারি কোষাগার থেকে নিয়েছেন ২ কোটি ৪২ লাখ ২৬ হাজার ৬১৯ টাকা। ডিআইএরর উপ-পরিচালক বিপুল কুমার সরকার বলেন, এমপিও হিসাবে ভুয়া সনদধারীরা যে টাকা গ্রহণ করেছেন আর্থিক নিয়ম অনুযায়ী তা ফেরতযোগ্য।

Leave a Comment

You may also like

Critically acclaimed for the highest standards of professionalism, integrity, and ethical journalism. Ajkerkotha.com, a new-generation multimedia online news portal, disseminates round-the-clock news in Bangla from highly interactive platforms.

Contact us

Copyright 2021- Designed and Developed by Xendekweb