আজ ৭ দিন পার হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে জননন্দিত রাজনৈতিক নেত্রী এবং রাষ্ট্রক্ষমতার প্রধান হকদার বেগম খালেদা জিয়া কারান্তরীণ। গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে একটি বানোয়াট মামলায় সাজা দিয়ে তাঁকে আড়াই’শ বছরের পুরাতন পরিত্যক্ত কারাগারের একটি ভবনে বন্দী করে রেখেছে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী শেখ হাসিনা। ঘটনার দিন থেকে দেশের সর্বমহলে আলোচিত হচ্ছে- খালেদা জিয়া কবে কিভাবে কারাগার থেকে বের হবেন। সচেতন লোকজন তখন ধরে নিয়েছিল, উচ্চ আদালতে জামিনের দরখাস্ত করলেই স্বাভাবিক নিয়মেই বেরিয়ে আসতে পারবেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এক সপ্তাহ পার হলেও কারাগার থেকে বের হওয়া তো দূরের কথা, এখন অবধি জামিনের দরখাস্তই করা যায়নি। কারন, মামলার রায়ের কপি দেয়া হচ্ছে না। তথাকথিত রায় পরীক্ষা নীরিক্ষা ও বেআইনী সংশোধনের নামে অনুলিপি দেয়া হচ্ছে না। মিডিয়াতে খবর- রায়ে ভুলভ্রান্তি মেরামতের কাজ চলছে! যেখানে ৬৩২ পাতা রায় ১০/১২ দিনেই লেখা হয়ে গেছে, এখন সেখানে কেবল কপি করতে ১০দিনেও পারছে না। অথচ আইনে বলা আছে, বিচারক পূর্নাঙ্গ রায় লিখে আদালতে ঘোষণা করতে হবে, এবং সই করতে হবে। রায় ঘোষণার পরে কোনোভাবেই পরে তা বদলানো যাবে না। জানা গেছে, রায়ের ভেতরে এত বেশি জাল জালিয়াতি মিথ্যাচার ও কুতর্ক রয়েছে যে, কপি দেয়া হলে তা প্রকাশ হয়ে পড়বে। তাই ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা এগুলো মেরামতের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আসলে যা কিছু হচ্ছে, কোনো আদালত বা বিচার নয়, বরং বাংলাদেশের বর্তমান বিনাভোটের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত খায়েশ পুরণ। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের মতে, নির্বাচন হাসিল এবং ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল। শেখ হাসিনা ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি হলেন তিন বারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী (প্রায় ৮০ভাগ জনসমর্থন যার), ৫টি জাতীয় নির্বাচনে কোথাও না হেরে সর্বোচ্চ ২৩টি আসনে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন যিনি, সেই বেগম খালেদা জিয়া। রাজনীতিতে খালেদা জিয়াকে বড় ভয় শেখ হাসিনার। কারন দেশে এখনি নির্বাচন হলে বেগম জিয়া বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে দেশের জননন্দিত প্রধানমন্ত্রী হবেন, এটা শেখ হাসিনাও জানেন। তাই শেখ হাসিনা দেশে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন দিচ্ছে না। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি বিনাভোটের একটি নির্বাচনের উপরে ভর করে ক্ষমতার চেয়ার আঁকড়ে আছেন তিনি। তার ক্ষমতার মূল শক্তি কিছু পুলিশ, র্যাব, ও দলীয় গুন্ডা। এই নিজস্ব বাহিনী দিয়ে বিরোধী দলের লোকদেরকে অপরহন গুম খুন কারান্তরীণ করে চলছে হরদম, প্রতিবাদীদের টুটি চেপে ধরেছে। এতকাল বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের উপরে মামলা হামলার নির্যাতন করা হলেও ১০ বছরের চেষ্টার পরে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি বেগম খালেদা জিয়াকে বন্দী করেন শেখ হাসিনা।
সুস্থ রাজনীতির ধারক বাহক বেগম জিয়া সর্বদা দেশের প্রচলিত আইন কানুন মেনে চলেন। প্রতিহিংসা নয়, সমঝোতার রাজনীতি করার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে বর্তমান ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা অবরোধ হরতাল জ্বালাও পোড়াও করে এমনকি নিজে আগুণ দিয়ে গাড়ি পুড়িয়ে, অন্যরা গান-পাউডার দিয়ে দোতলা বাস জ্বালিয়ে মানুষ হত্যা করে সমাজে বিভীষিকা তৈরী করে নিজের চাহিদা পুরণ করেছেন। বার বার বিপথগামী সেনাদের ব্যবহার করে ক্যু ঘটিয়ে ষড়যন্ত্রের রাজনীতির উপর ভর করে ক্ষমতায় আরোহন করেন। আবার অন্যের ডাকা হরতালে বোমাবাজি ও আগুণ দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করে বিপক্ষ দলকে দায়ী করতে শেখ হাসিনার জুড়ি মেলা ভার। এসব ক্ষেত্রে তার কাজ ম্যাকিয়াভেলি চানক্যকে হার মানায়। তিনি যা করেন, তা রীতিমত শিল্প। গত এক দশক শেখ হাসিনা এভাবেই ক্ষমতা দখলে রাখার পরে এবারে যখন তা হারানোর উপক্রম হয়েছেন, তখনই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি খালেদা জিয়াকে ছলে বলে কলে কৌশলে অনুগত আদালত ব্যবহার করে কারাবন্দী করেছেন। এর আগে দু’জন প্রধান বিচারপতিকে পর পর জোর জবরদস্তিমূলক অপসারন করে বিচারকদের দন্ডমুন্ডের কতৃত্ব হাতে নিয়েছেন হাসিনা, তারপরে এক জুনিয়ার জজকে দিয়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এই বানোয়াট রায় ঘোষণা করেছেন। ঠিক যেনো সিনেমার গল্প। মসনদের প্রধান দাবীদারকে গারদে পুরে নিত্য অত্যাচার করে মনের ঝাল মেটানোর কাহিনী! অবৈধ প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা হলো, যে কোনো কৌশলে তাঁকে আটকে রাখতেই হবে। আজ বৃহস্পতিবার এক সপ্তাহ পার হওয়ার পরেও সেই তাগুদি রায়ের কপি দেয়া হয়নি অবৈধ প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়, যাতে করে অন্তত আরও তিন দিন জামিনের দরখাস্ত না করতে পারেন খালেদা জিয়া। হয়ত এর অন্তরালে রয়েছে আরও কোনো কুবুদ্ধি। এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি- এই রায় ঘিরে সরকারের গভীর নীলনকশা রয়েছে। এখন দেখছি সার্টিফাইড কপি দিতে বিলম্ভ করা হচ্ছে। এসবের একটিই উদ্দেশ্য দেশনেত্রীকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা।’ এ বিষয়ে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন,‘খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘায়িত করতেই রায়ের সার্টিফাইড কপি দিতে দেরি করা হচ্ছে। বিএনপি এবং দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে নিয়ে গভীর একটি চক্রান্ত কাজ করছে।’
দু’দিন আগে বিনাভোটের পার্লামেন্টে শেখ হাসিনার ফুফাত ভাই শেখ সেলিম প্রচন্ড দম্ভের সাথে ঘোষণা দেন, “খালেদা জিয়াকে ডিভিশন জেলে নয়, রাখা হবে ফাঁসির আসামীদের কনডেম সেলে!” যদিও ৭দিন সাধারন বন্দী হিসাবে রাখার পরে জেল কতৃপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, খালেদা জিয়াকে এখন প্রথম শ্রেণীর বন্দী হিসাবে রাখা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তাঁকে বন্দী রাখা হয়েছে জনমানবহীন বিশাল এলাকায় এক নির্জন এলাকায় পরিত্যাক্ত এক বাড়িতে। হরর সিনেমার পোড়োবাড়িতে নির্জন পরিবেশে বিশাল এলাকায় দিনের বেলায় কাকের কা কা শব্দ, আর রাত হলেই নামে নির্মম নির্জনতা। এটা কারাগার নয়, সলিটারি কনফাইনমেন্ট। দু’শ বছরের বেশি বয়সী পরিত্যক্ত এ জেলখানায় আর কোনো বন্দী নেই। কেবল খালেদা জিয়া! তাছাড়া ২০০৬ সালের জুলাই মাস থেকে এটি আর কোনো জেলখানা নয়, বরং পরিত্যক্ত ভবন, যেকোনো সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে। খালেদা জিয়াকে যেখানে বন্দী রাখা হয়েছে, সেটি আর এখন কোনো সরকারী জেলখানা নয়, বরং অঘোষিত বন্দিশালা। সরকারী প্রজ্ঞাপণ দিয়ে এটি সাবজেল ঘোষণা করা হয়নি এখনও। যার অর্থ দাড়ায়- এ কারাবাস অবৈধ! অবৈধ সরকারপ্রধানের ইচ্ছাতেই পরিত্যাক্ত বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে ৭৩ বছর বয়েসী নারী সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে, যিনি নানা অসুস্থতায় ভুগছেন। দু’টি হাটু বদলানো, তীব্র ব্যথায় হাটতে পারেন না, বিশেষ ধরনের সেবাযত্নের দরকার হয়, যার কোনো ব্যবস্থা নাই সেখানে। ঐ ভবনের আশে পাশেই রয়েছে শত শত বছরের ফাঁসির কাষ্ঠ, যেখানে মৃত্যু ঘটেছে শত শত মানুষের, যা ভৌতিক অবস্থাকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। ১৭ একর জমির উপর নির্মিত ছোট বড় লাল লাল পুরোনো বিল্ডিং, চারিদিকে উঁচু প্রাচীর দেয়া, যেখানে বাস করে নির্জনতা আর ভুত প্রেত! নির্জন নির্বাসনে গা ছম ছম করা পরিবেশ। বিশাল মহিলা ওয়ার্ডজুড়ে ভয়াবহ মশার উৎপাত, নিয়ন্ত্রনের কোনো উপায় নাই। এটা নাকি ডিভিশন জেল! ডিভিশন দেয়ার মত কোনো ব্যবস্থা ওখানে নাই। শেখ হাসিনা ইচ্ছা করেই তার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাকে কেবল জেলের কষ্ট দিয়ে নয়, মানসিক টর্চার করে নিজের মনের ঝাল মিটাচ্ছেন।
নাজিমুদ্দিন রোডের এই অঘোষিত অবৈধ জেলখানায় বন্দী রাখা হয়েছে বাংলাদেশের তিন বারের প্রধানমন্ত্রী সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম জিয়াকে- কারাগারের নামে সেখানে চলছে ভয়াবহ মানসিক চর্চার। শ্রেনীপ্রাপ্ত জেলখানার কোনো সুযোগ সুবিধা নেই সেখানে। তারপরও ‘বিশেষ বন্দী’ নাম দিয়ে অবৈধ সরকার এই প্রহসন চালিয়ে হচ্ছে। জনমানবশুন্য এই বিশাল পোড়োবাড়িতে বন্দী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর ধারে কাছে কাউকে যেতে দেয়া হয় না। খাবার দাবার দিতে সেখানে কেউ গেলেও তাদের কথা বলা নিষেধ। এ এক ভয়াবহ নির্যাতন, প্রায় কনডেম সেলে থাকার মতো। জেলখানায় সাধারন বন্দীরাও এর চেয়ে মানবিক পরিবেশে থাকে। ৭০ বছর বয়স্ক এই সিনিয়র সিটিজেন নারীর প্রতি যে সহিংসতা চলছে, তার অতীত নজীর খুঁজে পাওয়া দুস্কর। জেলখানার পরিবেশ সম্পর্কে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অভিযোগ করেন, বেগম খালেদা জিয়াকে নির্জন কারাবাসে রাখা হয়েছে। সেখানে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে না। একটি পরিত্যক্ত ভবনে তাকে রাখা হয়েছে। যেখানে কোনও মানুষ নেই, অন্য আসামিও নেই। যেভাবে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্তদের নির্জন কারাবাসে রাখা হয়, সেভাবেই তাকে রাখা হয়েছে।
এর আগে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় বসেই ২০১০ সালের আগস্ট মাসে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাভারের জমি ও দোকানপাট আ’লীগের দলীয় লোকজন দিয়ে দখল করে নেন। ঐকাজেও ব্যবহার করা হয় একটি কনিষ্ঠ জজ আদালতের গোপন ত্রুটিপূর্ন মতলবি রায়। বৃহস্পতিবার নাকি কে বা কাহারা রায় পেয়েছে, শুক্রবার ছুটির ফাঁদে ফেলে শত শত পুলিশ দিয়ে ভাঙচুর করে খালেদা জিয়ার জমি বুঝিয়ে দেয়া হয় এক আওয়ামীলীগ নেতাকে। এর দু’মাস পরে আবার আদালতের রায়ের কথা বলে খালেদা জিয়াকে টেনে হেঁচড়ে জোর করে বের করে দেয়া হয় দীর্ঘ ৩৮ বছরের স্মৃতিবিজড়িত ক্যান্টমেন্টের শহীদ মইনুল রোডের নিজস্ব বাড়ি থেকে, যদিও সে মামলার আপিল বিচারাধীন ছিল। তখন বেগম জিয়াকে তার আইনজীবীদের সাথে কথা বলতে হয়নি। আইনজীবীরা ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে চাইলে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। খুব দ্রুতই খালেদা জিয়ার বাড়ি মাটির সাথে গুড়িয়ে দেয়া হয় হাসিনার নির্দেশে। এভাবে আদালতের ঘাড়ে পা রেখে বলপ্রয়োগ করে বাড়ি ঘর জমি জিরাত থেকে উৎখাত করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বেগম জিয়াকে অবশেষে পরিত্যক্ত পোড়োবাড়িতে বন্দী করে রেখে শেখ হাসিনা তাঁর জিঘাংসা প্রতিহিংসার উৎকট রূপ প্রকাশ করছেন। তবে হাসিনার এই জুলম ও অবিচার কর্মকান্ড দেশের মানুষ গ্রহণ করেনি, বরং উল্টো খালেদা জিয়ার প্রতি সহানুভূতি বাড়ছে। এমনকি আওয়ামীলীগের বহু লোকেরা মনে করছে, হাসিনা সমাজে প্রতিহিংসা ছড়াচ্ছেন।
তবে, আপাতত খালেদা জিয়ার রায়ের আপিলের দিকে তাকিয়ে আছে দেশের কোটি কোটি মানুষ। দিনে দিনে মানুষের আগ্রহ ও সহানুভুতি এমন ভাবে বাড়ছে যে, এটা এখন কোনো ব্যক্তির মামলা বা আপীল নয়, বরং কোটি কোটি জনতার প্রতিকার চাওয়া। অবৈধ সরকারের নিয়ম বহির্ভুত অন্যায় কার্যকলাপে জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে গেলে আর রক্ষা পাবে না আর কেহ।