কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে ৩৫ একর জমির ওপর প্রেসিডেন্ট পার্ক নামের একটি বিলাস বহুল রিসোর্ট তৈরি করেছেন পুলিশের বির্তকিত ঘুষখোর অতিরিক্ত ডিআইজি হারুন অর রশিদ। তিনি এখন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে যুগ্ম কমিশনার হিসেবে কাজ করছেন। এই রিসোর্টের মালিক কাগজে কলমে তার ভাই ও আত্মীয় স্বজন হলেও বাস্তবে মালিক হারুন অর রশিদ এবং এলাকার লোকজন এটিকে হারুন অর রশিদের রিসোর্ট হিসেবেই চেনেন। এলাকাবাসি নিশ্চিত করেছেন, এখানে বিনিয়োগের প্রায় পুরোটাই করেছেন হারুন। সম্প্রতি হারুন অর রশিদের তত্বাবধানে মৌসুমি, ওমরসানি সহ বেশ কয়েকজন চিত্রতারকা ও রাজনীতিবিদদের নিয়ে গিয়ে রিসোর্টটি উদ্বোধনও করা হয়েছে।

সেই রিসোর্টে হেলিকপ্টার ভাড়া করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন এর পরিবারের সদস্যদের ৭ সেপ্টেম্বর প্রমোদ ভ্রমণে নিয়ে যান হারুন অর রশিদ। তবে সবার চোখ ফাঁকি দিতে গাড়িতে যান সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন । তাদের সাথে ছিলেন ডিএমপিতে হারুনের গ্যাং মেম্বার হিসেবে খ্যাত যুগ্ম কমিশনার নূরুল ইসলাম ও আনিসুর রহমান।
যুগ্ম কমিশনার নুরুল ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ ব্যবহার করে বিসিএস এ উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, পরে বিষয়টি ধরা পরলে তার চাকরি চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধার ভূয়া সনদ দেয়ার অপরাধে তখন বেশ কিছুদিন তিনি জেলও খেটেছিলেন। আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ছাত্রলীগ করার কারনে তার চাকরি চলে গিয়েছিল বলে সবার কাছ থেকে সহানুভূতি আদায় করে চাকরি ফিরে পান ।
রিসোর্টের সেই ভ্রমনে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদান করেন হিজড়া খ্যাত ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান। বিসিএস ক্যাডারে পুলিশে চাকরি হবার আগে তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারি ছিলেন। সেখানে প্রশ্নপত্র আউট ও নম্বর পরিবর্তন করে তিনি পুলিশ ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে।
বিতর্কিত এই ব্যাক্তিরা সারাদিন হারুনের রিসোর্টে অবস্থান করে বিকেলে ঢাকা ফিরে আসেন। তবে সচিবের পরিবারের সদস্যদের জন্য R R Aviation থেকে ভাড়া করা হেলিকপ্টার তাদের নিয়ে গিয়ে, সারা দিন ওই রিসোর্টে অবস্থান করে বিকেলে পারিবারের সব সদস্যদের নিয়ে আবার ঢাকা ফিরে আসে। এয়ার টাইম ও অপেক্ষমান সময় সহ ওইদিন হেলিকপ্টরের ভাড়া বাবদই তিন লাখ টকা খরচ হয়েছে। যার সবই দিয়েছে বিতর্কিত হারুন।

এদিকে স্বরাষ্ট্র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন হাওরের এই প্রমোদ ভ্রমণটিকে তার সরকারি সফর হিসেবে দেখিয়েছেন। সচিবালয় থেকে প্রাপ্ত সফরসূচি থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ৭ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার কর্মদিবস ছিল। তাই স্থানিয় থানা ও নৌ পুলিশের কার্যক্রম পরিদর্শনে জন্য তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা সফরে যাচ্ছেন বলে সরকারি খাতায় উল্লেখ করা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে সেই দিন তিনি কোন থানা পরিদর্শন করেননি। রিসোর্টে মিঠামইন থানা ও নৌ পুলিশের দুটি পরিদর্শন বই এনে সেখানে স্বাক্ষর করেন আর এর মাধ্যমে একটি কর্মদিবসের কাজ ফেলে তিনি তার প্রমোদ ভ্রমণে বিষয়টির হালাল করেন।

কেন এই ভ্রমন?
সূত্রে জানা যায় সচিব ও পুলিশের এই বিতর্কিত কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি সমঝোতা বৈঠক সেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। হারুন, নূরুল ও আনিস অতিরিক্ত ডিআইজি হবার সময় যেমন শতাধিক কর্মকর্তাদের ডিঙ্গিয়ে পদোন্নতি পেয়েছেন। এবারও তারা ৩০০ জনকে ডিঙ্গিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডিআইজি হতে চান। এর বিনিময়ে তারা স্বরাষ্ট্র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীনকে ১৫ কোটি টাকা দেবার প্রস্তাব দেন বলে বিশ্বস্খ সুত্র নিশ্চিত করেছে। আর আগামী জানুয়ারিতে অবসরে যাওয়ার সময় চলে আসায় সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামালকে তারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাইয়ে দিবেন বলে আশ্বস্থ করেছেন।
ইতোপূর্বেও সচিব মোটা অংকের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে শতাধিক অফিসারকে টপকিয়ে তাদেরকে অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি দেন।
গুঞ্জন আছে পরীমনিসহ নানা কারনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ চাপের মুখে আছেন। তাই তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার জন্য এখন এই রিসোর্ট ভ্রমনের আয়োজন করছেন তার টাকায়।
বেনামে এই রিসোর্ট তৈরি করে হারুন অর রশিদ এখন মন্ত্রী ও আমলাদের জন্য প্রমোদের আয়োজন করে তার অবস্থান পোক্ত করতে চাইছেন বলে এলাকাবাসি মনে করেন। হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমান টাকা পাচার সহ নানা ধরনের অভিযোগ বহু বছর ধরেই আছে। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় থাকা তার স্ত্রীর কাছে ১১ শত কোটি টাকা পাচার করার পর শেষ রক্ষা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের Internal Revenue Service (IRS) এর কাছে টাকা গুলো আটকে যায়। কিন্তু রাজনৈতিক আর্শিবাদ থাকার কারনে তার বিরুদ্ধে কখনো কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। গাজিপুরে ও নারায়ণগঞ্জের এসপি থাকার সময় শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন বলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। নারায়ণগঞ্জের এসপি থাকার সময় চাহিদা অনুযায়ি টাকা না পাওয়ায় এক শিল্পপতির বাড়িতে হানা ও হয়রানিমুলক মামলা এবং গ্রেপ্তারের ঘটনা নিয়ে সাড়া দেশে তোড়পাড় হলে নারায়ণগঞ্জ থেকে হারুনকে সরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু তিনি আবার উর্ধতন মহলকে নানা ভাবে ম্যানেজ করে পুনরায় গুরুত্বপুর্ণ জায়গায় বদলি হয়েছেন। পরীমনির বাসায় যাতায়াত সহ কয়েকটি ইস্যুতে অবস্থান কিছুটা খারাপ হবার কারনে এখন স্বরাষ্ট্র সচিবসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের তার রিসোর্টে নিয়ে গিয়ে প্রমোদের ব্যবস্থা করছেন। সেখানে আসা যাওয়ার হেলিকপ্টার ভাড়া ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও তার তত্ববধানে হচ্ছে। হারুন এতোটাই ধুর্ত যে, সে গোপনে সকলের অপকর্ম রেকর্ড করে রাখে। প্রয়োজনে করে ব্লাক্মেইল।
হারুনের বাবা ও তার পরিবারের তেমন কোন সম্পদ ছিল না কিন্তু এখন কি এমন আলাদীনের চেরাগ পেলেন যে শত কোটি টাকার রিসোর্ট বানাচ্ছেন আবার সেখানে নিজ খরচায় আমলাদের নিয়ে যাচ্ছেন সেই প্রশ্ন কিশোরগঞ্জের মানুষের মুখে মুখে।