৬ মে, ২০২২
ঋণ করিয়া ঘি খাওয়া নয়, রীতিমত আমেরিকার মাটিতে ফুটানকি করছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার! ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে কনসার্ট আয়োজন করেছে, যার কোনো সত্যিকারের হিসাব কারো কাছে পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পুর্তি এবং মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ঐতিহাসিক মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে স্থানীয় সময় শুক্রবার ৬ মে আয়োজন করা হয়েছে ‘গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ কনসার্ট’। এর জন্য বাংলাদেশ সরকার থেকে ১০ কোটি টাকা দেয়ার খবর প্রকাশ করলেও বাস্তবে এর বাজেট ৫০ মিলিয়ন ডলার, জানিয়েছেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী পলকের এক ঘনিষ্ট বন্ধু।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত এত বিশাল খরচের একটি আন্তর্জাতিক মানের কনসার্টের আয়োজন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৯৫ শতাংশ বাংলাদেশিই জানেন না। এ নিয়ে প্রবাসীদের মাঝে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ কনসার্টের কোনো প্রচার প্রচারণাও নেই কোথাও। অনুষ্ঠানের খবর স্থানীয় মেইন স্ট্রিম মিডিয়ায় প্রকাশ হয়নি। নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ১৫টি সাপ্তাহিক পত্রিকার মধ্যে স্বল্প প্রচারের ৩/৪টি পত্রিকায় দায়সারা গোছের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে। এসব বিজ্ঞাপনে কনসার্টের সময়সূচি, টিকেটের মূল্য, টিকেট কোথায় পাওয়া যাবে, কার সঙ্গে প্রয়োজনে যোগাযোগ করা যাবে সেসব বিষয়ের কোনো উল্লেখ নেই। দায়সারা গোছের সীমিত আকারের প্রচারের কারণে ২২ হাজার আসনের মধ্যে মাত্র ৪ হাজার টিকেট বিক্রি হয়েছে। এ মিলনায়তনের এক দিনের ভাড়া প্রায় অর্ধ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। শেষ মুহুর্তে ১০০ ডলারের টিকেটের দাম চলে এসেছে ৫৫ ডলারে! এমন ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থায় শেষ মুহুর্তে কনসার্টের একদিন আগে নিউইয়র্ক কনস্যুলেটে আইসিটি মন্ত্রী জুনাইদ পলক একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এতে আয়োজনের সীমাবদ্ধতা, ব্যয় নিয়ে লুকোচুরি, এবং স্পন্সর নিয়ে ব্যাপক প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন পলক, যার কোনো সদুত্তর দিতে পারেন নি। শেষ মুহূর্তে কনসার্টের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করায় প্রবাসীদের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এই কনসার্ট নিয়ে সাধারণ বাংলাদেশীদের মধ্যে তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের জন্য ১৯৭১ এর ১ আগস্ট এই ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবিশঙ্করের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ কনসার্ট’। আর এ কনসার্ট ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের জন্য। তাদেরই স্মরণে ৬ মে বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয়ের হাইটেক পার্ক বিশাল বাজেটে এই কনসার্ট আয়োজন করেছে। প্রায় বছর খানেক আগে এই কনসার্টের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হলেও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশীদেরকে জানানোর ব্যবস্থা করেনি আয়োজকরা। বিশাল বাজেটের এই কনসার্ট উপভোগ করতে বাংলাদেশ থেকে মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও তাদের পরিবারের বহু সদস্য সহ তিনটি চার্টার্ড ফ্লাইটে সহস্রাধিক লোকে নিউ ইয়র্কে আসছেন বলে জানা গেছে, যাদের মধ্যে সরকার দলীয় লোক এবং কর্মকর্তারা রয়েছেন। বিদেশ যাওয়া সংক্রান্ত একটি সরকারি আদেশে দেখা যায়, এতে অংশ নিতে সরকারের দুই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, তিনজন সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা ও তাঁদের আত্মীয়স্বজনসহ ৫৫ জন গেছেন। এদের মধ্যে আইসিটি বিভাগসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রকল্প ও দপ্তরের আছেন ৩১ জন। এত কর্মকর্তা কেন যাচ্ছেন, কোন মাপকাঠিতে যাচ্ছেন, তাঁদের কাজ কি, খরচ দিবে কে এ সংক্রান্তে কোনো সদুত্তর মিলেনি।
হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের এমডি বিকর্ণ কুমার ঘোষ জানান, এ আয়োজনে সরকার দিয়েছে ১০ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ এই কনসার্টে সহায়তা (স্পনসর) করছে। কোন্ প্রতিষ্ঠান কত টাকা দিচ্ছে, সেটা জানা যায়নি। জিও অনুযায়ী, আইসিটি বিভাগসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, সরকারের অন্য বিভাগের কর্মকর্তা ও সাংসদদের ব্যয় আইসিটি বিভাগ, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, আইসিটি অধিদপ্তর এবং আইসিটি বিভাগের চলমান বিভিন্ন প্রকল্প থেকে ধরা হয়েছে। আইসিটি বিভাগ ও এর অধীন ছয়টি প্রকল্প, আইসিটি অধিদপ্তর, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের মোট ৩১ জন কনসার্টে যোগ দিতে যাবেন। এই তালিকায় আইসিটি বিভাগের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, তাঁর একান্ত সচিব সাইফুল ইসলাম এবং প্রতিমন্ত্রীর দু’জন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা রাকিবুল ইসলাম ও একরামুল হক, আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. খায়রুল আমিন ও খন্দকার আজিজুল ইসলাম, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন প্রকল্প পরিচালক মোস্তফা কামাল, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকর্ণ কুমার ঘোষ এবং তাঁর মেয়ে ও প্রকল্প সহায়ক গীতাঞ্জলী ঘোষ। আরও যাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, তাঁর একান্ত সচিব মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ কে এম রহমতুল্লাহ, তাঁর একান্ত সচিব মো. মনিরুজ্জামান, কমিটির সদস্য নুরুল আমিন ও অপরাজিতা হক; সংরক্ষিত আসনের সাংসদ নাহিদ ইজাহার খান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমম্বয়ক জুয়েনা আজিজ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজমা মোবারক, পরিকল্পনা কমিশনের সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর আলম। তাদের সঙ্গে আরও যাচ্ছেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলেকের মা জামিলা আহমেদ ও বোন ফারজানা আহমেদ, সাংসদ নুরুল আমিনের স্ত্রী রোকশানা পারভীন, সাংসদ অপরাজিতা হকের স্বামী মোজাম্মেল হক, এ কে এম রহমতুল্লাহর স্ত্রী হালিমা রহমতুল্লাহ, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের স্ত্রী তাপসী ঘোষ, আইসিটি বিভাগের উপসচিব রেজা মো. আবদুল হাইয়ের স্ত্রী নিলুফার ইয়াসমিন, জেলা পর্যায়ে আইটি/হাইটেক পার্ক স্থাপন (১২টি জেলায়) প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম ফজলুল হকের স্ত্রী ফারহানা আরাবিয়া, আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিবের স্ত্রী লাকি আক্তার ও তিন মেয়ে। এই বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ম্যাডিসন স্কয়ার বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেই স্থানে ৫০ বছর পর কনসার্টের উদ্যোগটি ভালো। কিন্তু যেসব সরকারি কর্মকর্তা যাচ্ছেন, তাঁরা কোন মাপকাঠিতে যাচ্ছেন, আয়োজনের সঙ্গে তাঁদের কী সম্পৃক্ততা এবং কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা সরকারি আদেশে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। তাঁর মতে, যাঁরা যাচ্ছেন, সেখানে কার কী দায়িত্ব, সেটার জবাবদিহি প্রয়োজন। সরকারি টাকায় এই ব্যয়বহুল ভ্রমণের পেছনে যৌক্তিকতা না থাকলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।