✍️শামসুল আলম
পূর্ব পাকিস্তনের সংকটটি ছিলো ত্রিমাত্রিক। এর প্রথম মাত্রাটি ছিলো ইয়াহিয়া, মুজিব, এবং ভুট্টোর মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। ইয়াহিয়া চেয়েছিলেন ক্ষমতা ধরে রাখতে; মুজিব ও ভুট্টো উভয়ে চেয়েছিলেন ক্ষমতায় যেতে। সত্তরের নির্বাচনে ১৬৭ আসনে বিজয়ী মুজিবকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন করা হলে ৮৫ আসনের ভুট্টোকে বসতে হয় অপজিশন বেঞ্চে, আর তেমনটি ঘটলে ইয়াহিয়াকে প্রেসিডেন্ট হতে সরিয়ে দেয়ার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন ভুট্টো। এ অবস্থায় ক্ষমতার মূল দাবীদার বিজয়ী মুজিবকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে ১৭ জানুয়ারী ১৯৭১ ভুট্টোর বাগানবাড়িতে ইয়াহিয়া ভুট্টোর মধ্যে গোপন সলাপরামর্শ হয়, যা ’লারকানা ষড়যন্ত্র’ নামে পরিচিত। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়-
ক) মুজিবকে ক্ষমতা থেকে হটাতে অ্যাসেম্বলি অধিবেশন স্থগিত করা হবে;
খ) আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথকে কূটনৈতিকভাবে রুদ্ধ করা হবে; এবং
গ) সেনাবাহিনী ব্যবহার করে পূর্বাংশকে ভীতি-প্রদর্শন করে গণআন্দোলন দমন করা হবে (সূত্র: Bhutto, Z.A. The Great Tragedy, page 20).
এর সাথে যুক্ত হয় ‘এম এম আহমেদ প্লান’, যার অধীনে ইয়াহিয়াকে প্রেসিডেন্ট বহাল রেখে ভুট্টোকে প্রধানমন্ত্রী করার লক্ষে সম্ভব হলে পাকিস্তান ভাঙ্গার অযুহাত তুলে পূর্ব পাকিস্তানের এসেম্বলি বাতিল করা হবে। অন্যদিকে, আওয়ামীলীগ ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নে অনড় থাকলে ইয়াহিয়া এবং ভুট্টোর জন্য কাজটি সহজ হয়ে যায়! তখন এ অবস্থাকে পাকিস্তানের জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদ হিসাবে আখ্যা দিয়ে ঢাকায় ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করেন ইয়াহিয়া।
দ্বিতীয় মাত্রাটি ছিলো, পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের স্বাধীকারের আকাঙ্খা, যা দীর্ঘ কাল ধরে বিভিন্ন গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার গণদাবীতে রূপ নেয়। সত্তরের নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে সামরিক জান্তার টালবাহানার প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলায় গণআন্দোলন শুরু হয়। সরকারী ও বেসরকারী বলপ্রয়োগে বিভিন্নস্থানে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে, এমনকি পাকিস্তানপন্থীরাও হতাহত হয়। মার্চের পয়লা তারিখ থেকেই পূর্বপাকিস্তানের স্বাধীনতার দাবীতে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানী ঢাকা এবং বড় বড় নগরী।
এ সময় মাওলানা ভাসানী স্বায়ত্বশাসনের পরিবর্তে ‘স্বাধীন দেশের’ দাবী তোলেন। ছাত্র-জনতা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে এগিয়ে গেলেও নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতার দাবীদার মুজিব একদিকে ছাত্র জনতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন, অন্যদিকে জনতাকে উদ্দীপ্ত করে ইয়াহিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল অবলম্বন করেন। ক্ষমতা হস্তান্তরে ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষে ৭ মার্চের ভাষণে চার দফা শর্ত দিয়ে ‘এবারের সংগ্রাম…স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা দিয়ে জনতাকে উত্তেজিত করলেন মুজিব। অন্যদিকে, ক্ষমতা হস্তান্তরের ইস্যুতে ১৬ থেকে ২৪ মার্চ ব্যাপী ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার অযুহাতে সময় ক্ষেপণ হয়, যাতে পশ্চিম থেকে পূর্বপাকিস্তানে লাখ খানেক সৈন্য ও পর্যাপ্ত গোলাবারুদের সমাবেশ ঘটানোর সুযোগ লাভ করে।
মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা যথারীতি ব্যর্থ হয়, এবং ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই “অপারেশন সার্চ লাইট” অভিযানে বাঙ্গালী নিধন শুরু করে পাক বাহিনী। মূলতঃ এ আক্রমন কেন্দ্রীভূত ছিলো ঢাকার পিলখানায় ইপিআর ও রাজারবাগে পুলিশের বাঙ্গালী সদস্যদের উপর, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, ও পুরান ঢাকায় হিন্দু প্রধান এলাকায়। আক্রমনের প্রথম প্রহরেই নিহত হয় কয়েক হাজার নিরিহ মানুষ। নিশ্চিত আক্রমনের আগাম খবর পাওয়ার পরও মধ্যরাত অবধি মুজিব ইয়াহিয়ার উপর আস্থায় অবিচল থেকে শেষে তারই পরামর্শ মোতাবেক পাকবাহিনীর হাতে ধরা দিলেন। কেননা, আটক হওয়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত মুজিব অপেক্ষায় ছিলেন ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি জেনারেল পীরজাদার একটি টেলিফোন কলের, যাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তিতে সই করার আমন্ত্রণ আসার কথা ছিল।
যদি তাই ঘটতো তবে মুজিব-ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তর চুক্তি সই হতো—মুজিব ক্ষমতা পেতেন বটে, কিন্তু এ জাতি কখনই আর স্বাধীনতার মুখ দেখতে পেত না। প্রকৃত বিবেচনায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘটার অঘটনটি করে দিয়েছে ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার বাড়াবাড়ি।
ঢাকায় ক্রাকডাউনের একই সময়ে চট্টগ্রামে অবস্থিত অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহ-অধিনায়ক বাঙ্গালি মেজর জিয়া ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন (ক্যালেন্ডারে তখন ২৬ তারিখ)। প্রথমে নিজ ইউনিটে ও পরে স্থানীয় বেতার মারফত বাংলাদেশের ’স্বাধীনতা ঘোষণা’র কথা বিশ্ববাসীকে জানান দেন, এবং সবাইকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়ার আহবান জানান।
চট্টগ্রামের এ সেনাবিদ্রোহ বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অন্যতম মাইল ফলক, যার অনুসরণে একে একে পূর্ববাংলার সকল বাঙ্গালী সেনা ইউনিট, ইপিআর ও পুলিশের প্রায় এগারো হাজার যোদ্ধা স্বাধীনতার লড়াইয়ে যোগ দেয়। অপরদিকে, পাকবহিনীর আক্রমণে দিশাহারা নিরস্ত্র জাতি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর ছাড়িয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী ভারতে। পাক বাহিনীর হাতে ধরা দেয়ার আগে শেখ মুজিব তাঁর সাধারন সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমেদের মাধ্যমে দলীয় নেতাকর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার নির্দেশনা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, কিন্তু ফিরিয়ে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা ঘোষণার প্রস্তাব। অতঃপর আওয়ামীলীগের বেশীর ভাগ নেতাকর্মী কলকাতা, আগরতলা শিলিগুড়ি সহ ভারতের সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে আশ্রয় নেয়।
যুদ্ধরত বাঙালি সেনা কমান্ডাররা ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে এক বৈঠকে মিলিত হল, এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র দেশকে ৮টি সেক্টরে ভাগ করেন, কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত করেন। এর দু’সপ্তাহ পরে ১৭ এপ্রিল আওয়ামীলীগের নির্বাচিত জণপ্রতিনিধিরা ভারত সরকারের আনুকুল্য নিয়ে প্রবাসী সরকার গঠন করে এবং চট্টগ্রামের সেনাবিদ্রোহ ও যুদ্ধের তৎপরবর্তী কার্যক্রমকে অনুমোদন করেন।
দেশকে হানাদার মুক্ত করার লক্ষে প্রথমে সীমিত আকারে ও পরে ব্যাপকভাবে বাংলার ছাত্র-যুবক-জনতা যোগ দেয় মুক্তিফৌজে। একদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বর্ডার ফোর্সের তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় “মুক্তিবাহিনী”, অন্যদিকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ’র’ এর আয়োজনে গঠিত হয় রেডিক্যাল “মুজিব বাহিনী”। যদিও মে জুন মাসে নাগাদ গোটা দেশ পাক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ চলে আসে, কিন্তু জুনের পর থেকে মুক্তিবাহিনীর প্রথম দল ট্রেনিং শেষে স্বদেশে গেরিলা অপারেশন শুরু করলে পাকবাহিনী ক্রমশ সীমান্তের দিকে ছড়িয়ে পরে। এ সুযোগে দেশের মধ্যে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। সেপ্টেম্বর নাগাদ মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্রের যোগান বৃদ্ধি পায়, ফলে পাকবাহিনী নিয়মিতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি হতে থাকে। নভেম্বরে বাংলাদেশের নিয়মিত সেনাবাহিনী ও নৌকামান্ডেরা বিভিন্ন রনাঙ্গণে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য লাভ করলেও আধুনিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে চুড়ান্ত বিজয় ছিলো এক অনিশ্চিত যাত্রা।
তৃতীয় মাত্রাটি ছিলো, ভারত ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের অবস্থান। ২৫ মার্চের পরে পূর্বপাকিস্তানে ইয়াহিয়ার সামরিক হামলা উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সীমান্ত খুলে দেন এবং ১ কোটি পূর্ব পাকিস্তানী বাঙ্গালীকে আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সহানুভূতি লাভে সফল হন। পূর্বপাকিস্তানে শুরু হওয়া প্রতিরোধ যুদ্ধকে প্রথম দিকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা গুরুত্ব না দিলেও কয়েক মাসের সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং ও অস্ত্র নিয়ে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা সমর শুরু করলে ক্রমশ বিপর্যস্ত হতে থাকে দখলদার বাহিনী। জনগনের মধ্যে ব্যাপক গণভিত্তি মুক্তিবাহিনীকে অনেকখানিই এগিয়ে দেয়। যার ফলে নানাবিধ প্রয়াস ও কৌশল অবলম্বন করেও গেরিলাবাহিনীর তৎপরতা দমনে ব্যর্থ হয় দখলদাররা।
পাকিস্তানের পুরোনো মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধ প্রতিরোধে সমর্থন জানায়, তথা পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষায় বদ্ধপরিকর ছিল। পাকিস্তানের অপর মিত্র চীনও প্রথম থেকেই ইয়াহিয়ার পক্ষ নেয়। উপমহাদেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবকে কোনাঠাসা করতে জুলাইয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতিরক্ষা সহকারী হেনরি কিসিঞ্জারের চীন সফরের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং গণচীন আরও নিকটবর্তী হয়।
মার্কিন ও চীনের যৌথ সহায়তা ভারতের জন্য বিপজ্জনক প্রতীয়মান হলে স্নায়ুযুদ্ধে রত সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের সহায়তায় এগিয়ে আসে এবং ৯ আগস্ট ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তি সই করে, যার নবম ধারায় যুদ্ধাক্রান্ত হলে পরস্পরকে সামরিক সাহায্যদানের অঙ্গীকার ছিলো। একই সময় পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী শেখ মুজিবকে ইয়াহিয়ার সরকার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত করে বিচারের সম্মুখীন করার উদ্যোগ নিলে ইন্দিরা গান্ধী মুজিবের পক্ষে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বিশ্বভ্রমনে নেমে পরেন। এমনকি তিনি ওয়াশিংটন সফর করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে জানিয়ে আসেন, পূর্বপাকিস্তানের সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনবোধে সামরিক ব্যবস্থা নিতে পারেন।
অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তান এবং তৃতীয় সপ্তাহে ভারত পূর্ব ও পশ্চিম উভয় সীমান্তেই নিজ নিজ সৈন্য সমাবেশ সম্পন্ন করে। স্ব স্ব সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার ও জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে জাতিসংঘে মার্কিনী উদ্যোগ চলে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ অবধি, যা সোভিয়েট ইউনিয়নের ভেটো দানে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অন্যদিকে পূর্বপাকিস্তান সংকট সমাধানে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য সেনাপ্রধান জেনারেল মানেক শ’র পরামর্শে ইন্দিরা গান্ধী শীতকাল অবধি সময় ক্ষেপণের পক্ষপাতি ছিলেন, যাতে করে ভারত-তিব্বত সীমান্তের সকল গিরিপথ বরফে আচ্ছাদিত হয়ে চীনা বাহিনীর ভারতবিরোধী দক্ষিণমুখী অভিযান প্রাকৃতিকভাবে রুদ্ধ হয়। পূর্ব ফ্রন্টের যুদ্ধ ক্রমশ বিপজ্জনক দিকে মোড় নেয়ার প্রেক্ষাপট্ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ ডিসেম্বর জম্মু ও পাঞ্জাবের ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে পাক-ভারত যুদ্ধ ত্বরান্বিত করেন। এমনই কিছুর জন্য অপেক্ষায় ছিলেন ইন্দিরা গান্ধি।
পশ্চিম ফ্রন্টে পাকিস্তানের আক্রমণের সমুচিত জবাব দিতে ঐদিনই মধ্যরাতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং পূর্ব ও পশ্চিম উভয় ফ্রন্টে যুদ্ধ শুরু হয়।
পাক-ভারত যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ৩ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার বিশেষ মন্ত্রিসভা বৈঠকে জানান, “শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনই নয়, বরং ভারতের উদ্দেশ্য হচ্ছে, পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের গুরুত্বপূর্ণ এক অংশের দখল নেয়া এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়া, যাতে পাকিস্তান ভবিষ্যতে আর কখনো ভারতকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে।” এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, নৈতিক অথবা আদর্শিক অনুপ্রেরণায় ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সাহায্য ও সমর্থন দেয়ার চেয়ে বরং কাশ্মীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করা এবং পাকিস্তান ভেঙে দেয়াই ছিল ইন্দিরা গান্ধীর প্রধান উদ্দেশ্য। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ তাতে ছিল একটি ’গৌণ পার্শ্ব-ফলশ্রুত’ মাত্র (Secondary by-product)–অনুপ ধরের এ উক্তির যথার্থতা প্রতীয়মাণ হয়। তবে ঐ কেবিনেট সভায় ইন্দিরা গান্ধীর আরেকটি বাক্য ছিলো, যে সুযোগের জন্য ভারত পচিশ বছর ধরে অপেক্ষা করছে, তা হেলায় হারাতে পারে না।
ভারতের দু’দিকে পাকিস্তানবেষ্টিত হওয়ায় এর প্রতিরক্ষা ছিলো অত্যন্ত বিপজ্জনক ও ব্যয়বহুল। বিশেষ করে, এক দশক ধরে ভারতের পূর্বাঞ্চলের নাগা ও মিজো বিদ্রোহীদের পূর্বপাকিস্তানে আশ্রয় দান, ট্রেনিং ও অস্ত্রশস্ত্র প্রদান করে আসছে এমন অভিযোগ ভারতের। আর তা বন্ধ করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করার এটাই ছিল সর্বোত্তম সুযোগ।
৩ ডিসেম্বর ভারত সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে জড়ানোর ৫ দিনের মধ্যেই বিমান বাহিনীর সহায়তায় পশ্চিম, পূর্ব ও উত্তর দিকে দিয়ে ভারতীয় স্থলবাহিনী প্রবেশ করে পূর্ববাংলায়। মিত্রবাহিনীর দ্রুত ও সাঁড়াশি আক্রমনে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পাকিস্তানের পূর্ব কমান্ড পরাজয়ের কাছাকাছি পৌছে যায়। পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার্থে জাতিসংঘে যুদ্ধ বিরতির মার্কিনী জোর প্রয়াস চলতে থাকে, যা সোভিয়েত বিরোধিতায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ’হট লাইনে’ পারমানবিক শক্তি প্রয়োগের হুমকির কথা সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভকে জানিয়েও যুদ্ধ বন্ধ করতে ব্যর্থ হন (Kissinger, H. The White House Years, p. 909-10). ৬ ডিসেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ মুক্ত করার কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহন করে। এ সময়, পূর্বপাকিস্তানে শোচনীয় সামরিক পরিস্থিতি এড়াতে ইয়াহিয়া খান বেসামরিক প্রতিনিধিদের হাতে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের অযুহাতে নতুন খেলা শুরু করেন।
৮ই ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান থেকে নুরুল আমিনকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উপপ্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। অন্যদিকে ১১ ডিসেম্বর ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ড ঘোষণা করেন ইন্দিরা গান্ধী। পাকিস্তান রক্ষায় মার্কিন কূটণৈতিক প্রয়াস ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইয়াহিয়ার সাহায্যার্থে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরী ’সপ্তম নৌবহর’কে বঙ্গোপসাগরে দিকে প্রেরণের নির্দেশ দেন। পূর্ব ফ্রন্টের পাক বাহিনী প্রধান জেনারেল নিয়াজীর আশা ছিল, উত্তর দিক থেকে চীনা বাহিনী আর দক্ষিন দিক থেকে মার্কিন নৌ আক্রমনে ভারতকে ঘিরে ফেলা হবে, যাতে করে ভারত সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। তবে চীনা সহায়তা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষে ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ব্যক্তিগত প্রতিনিধি’ জুলফিকার আলী ভুট্টোর চীনে কূটনৈতিক মিশন ব্যর্থ হওয়া স্বত্ত্বেও বিষয়টি গোপন রাখা হয়।
বাস্তবে, ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তির প্রভাব ও সোভিয়েত-চীন সীমান্তে উসূরী নদী বরাবর চল্লিশ ডিভিশন সৈন্য এবং সিংকিয়াং সীমান্ত বরাবর আরও ৬/৭ ডিভিশন সোভিয়েট সৈন্যের উপস্থিতি প্রভৃতি বিষয় বিবেচনা করে চীন অবশেষে ভারত অভিযানে আর উদ্যোগী হয়নি। পূর্বপাকিস্তানে সম্ভাব্য মার্কিন অভিযান রোধ করতে আগেই সোভিয়েত সাবমেরিনসহ মোট ষোলটি যুদ্ধজাহাজ ও সরবরাহ জাহাজ বঙ্গোপসাগরে বা তার আশেপাশে সমবেত করা হয় (The Anderson Papers, p. 259-60). প্রশান্ত মহাসাগর থেকে মার্কিন রণতরী ’সপ্তম নৌবহর’ বঙ্গোপসাগরে পৌছার প্রয়োজনীয় ৪/৫ দিন সময়ের আগেই ভারতীয় বাহিনী পূর্বপাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ব্যাপকভাবে বিমান হামলা চালায়। ১৪ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা চলাকালে ঢাকায় গভর্নর হাউজে ভারতীয় বিমান হামলা চালায়, ফলে পদত্যাগ করে মালেক মন্ত্রিসভা। গভর্নর ভবন ছাড়াও এদিন ঢাকার সামরিক লক্ষ্যবস্তুসমূহের উপর ভারতীয় বিমান আক্রমণ অব্যাহত থাকে।
যশোর, কুমিল্লা, সিলেট ও উত্তরবঙ্গে এক এক করে নিয়াজীর দুর্গ যখন পতন হচ্ছিল, তখনও রাওয়ালপিন্ডির সামরিক কর্তারা নিয়াজীর মনোবল ধরে রাখার জন্য ’চীনের তৎপরতা শুরু হয়েছে’ বলে ফাঁকা আওয়াজ জারী রাখে। কিন্তু বাস্তব সাহায্য আসার কোনো লক্ষন তখনও দৃশ্যমান হয়নি। চীনের কাঙ্খিত ভারত অভিযানের জবাবে সোভিয়েত রাশিয়া যদি চীন আক্রমন করে, তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা নেবে, এমন আশ্বাসের পরেও চীনারা সম্ভাব্য বিশ্বযুদ্ধ এড়াতে ইয়াহিয়ার সহায়তায় সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসা থেকে বিরত থাকে। অন্যদিকে ভারতের টার্গেট ছিলো, মার্কিন ও চীনা সাহায্য পৌছার আগেই পাক বাহিনীকে পরাভূত করা। এই লক্ষে ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভারতের সরকারী মাধ্যম থেকে ঘোষণা করা হয়, পাকিস্তান যদি পূর্ব বাংলায় তাদের পরাজয় স্বীকার করে নেয়, তবে সকল ফ্রন্টেই যুদ্ধ বন্ধ করবে ভারত। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো ভূখন্ড দখল করার অভিপ্রায় ভারতের নেই।
অতঃপর ভারতীয় কমান্ড এক মনস্তাত্বিক কৌশলে পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পনের জন্য ১৪ তারিখ পর্যন্ত আল্টিমেটাম প্রয়োগ করে, যদিও ঢাকার চুড়ান্ত পতনের জন্য ভারতের প্রয়োজনীয় ট্যাংক বাহিনী ছিলো মেঘনার ওপারে। অন্যদিকে, পশ্চিম ফ্রন্টেও পাকবাহিনী সুবিধা করতে না পেরে ক্রমান্বয়ে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। পশ্চিম ফ্রন্টে রাজস্থান-সিন্ধু সীমান্তের যুদ্ধে এগিয়ে থাকে ভারত; করাচীর উপর ভারতীয় নৌ ও বিমান আক্রমণ অব্যাহত থাকে। এ অবস্থায়, পাকিস্তানের মূল ভূখন্ড রক্ষা জন্য ভারতের প্রস্তাবিত আত্মসমর্পনের প্রস্তাবে সাড়া দিতে রাজী হন ইয়াহিয়া। ১৪ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান পূর্ব কমান্ডকে পরিস্কার নির্দেশ দেন আত্মসমর্পনের জন্য। কিন্তু নিয়াজী শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
বিপদাপন্ন পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করতে ভারতের কাছে পূর্ব কমান্ডকে অস্ত্রসমর্পনে ইয়াহিয়ার আগের নির্দেশ প্রতিপালনের জন্য ১৫ ডিসেম্বর সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদ এবং এয়ার চীফ মার্শাল রহিম টেলিফোন করে জেনারেল নিয়াজীকে পূণ:নির্দেশ দেন। নিয়াজী তার জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারে বলেছেন,”পাক হাইকমান্ডের গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পূর্ব কমান্ডের সাথে প্রতারণা করেছিল, কূট-কৌশলের আশ্রয় নিয়ে পূর্ব কমান্ডকে ভুল পথে পরিচালিত করেছিল, এবং একটি বিস্তৃত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পূর্বাংশকে বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল।” বাস্তবে, রণাঙ্গনের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে পিন্ডির কাছে সঠিক খবর ছিলো না, অধিকন্তু নিয়াজিকে ভুয়া বৈদেশিক সাহায্যের আশ্বাস দেয়া হয়। অধিকন্তু, বিরূপ প্রকৃতি ও বৈরী জনগনের মধ্যে ন’মাস ব্যাপী অন্যায্য যুদ্ধে দখলদার বাহিনী ছিল পরিশ্রান্ত এবং মনোবল ভাঙ্গা।
বাস্তবিক অর্থে, বৈদেশিক সহায়তার উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার কারণে ইয়াহিয়ার বাহিনী মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে একাকী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আত্মশক্তি হারিয়ে ফেলে। এ পরিস্থিতির মধ্যেই, পাকিস্তানী জওয়ান ও অফিসারদের উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পনের জন্য ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেক শ’র মনস্তাত্ত্বিক চাপ আকাশবাণী থেকে প্রচারিত হতে থাকে।
মার্কিন-চীনের সক্রিয় অংশগ্রহন হলে মহাদেশীয় যুদ্ধ বিস্তারের আশঙ্কা ছিল, এমনকি মার্কিন সপ্তম নৌবহরের সম্ভাব্য হামলার হুমকির মুখেও ভারতীয় বাহিনী তরিৎ ব্যাপক আক্রমনের পাশাপাশি প্রচারণা যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাফল্য লাভ করে। যার ফলে, পূর্ব পাকিস্তান ভূখন্ডে প্রায় লক্ষাধিক সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনী উপস্থিতি সত্ত্বেও রাজধানী ঢাকা রক্ষার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই ভারতীয় বাহিনীর ’আত্মসমর্পনের আল্টিমেটামে’ সাড়া দেয় পাক ইস্টার্ন কমান্ড। মূলত ১১ তারিখের মধ্যেই যুদ্ধ পাকিস্তানের হাতছাড়া হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে, ১৬ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে ৪ টায় ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভারতীয় জেনারেল অরোরার কাছে নিয়াজীর বাহিনী আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে, যেখানে যৌথ কমান্ডের বাংলাদেশ অংশকে অনুপস্থিত রাখা হয়।
এভাবেই জন্ম লাভ করে নতুন রাষ্ট্র ’বাংলাদেশ’, যা ন’মাস আগে ঘোষিত হয়েছিল কালুরঘাটের একটি ছোট্ট বেতারকেন্দ্র থেকে। এ আত্মসমর্পনকে পাকিস্তানের ওপর ভারতের যুদ্ধজয় হিসাবে নিশ্চিত করতে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মিত্রবাহিনীর বাংলাদেশ প্রধান জেনারেল ওসমানী যাতে উপস্থিত থাকতে না পরেন, সেজন্য ঢাকায় আসা আটকে দেয়া হয়েছিলো। যার স্বীকৃতি মিলে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত জেএন দীক্ষিত তার ‘ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ইন ওয়ার এন্ড পীস’ পুস্তকে, জেনারেল ওসমানীর অনুপস্থিতি সম্পর্কে লিখেছেন, “his helicopter had been sent astray so that he could not reach Dacca in time and the focus of attention at the ceremony would be on the Indian military commanders.” মইদুল হাসানের ভাষায়, ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেক’শ “বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার আগে পাক বাহিনীকে বরং ভারতীয় বাহিনীর কাছে” পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ করানোর চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে উঠেন।